SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Social Account

Admission

১৩ই এপ্রিল : মঙ্গলবার ১৯৭১
চারদিন ধরে বৃষ্টি। শনিবার রাতে কি মুষলধারেই যে হলো, রোববার তো দিনভর একটানা গতকাল সকালের পর বৃষ্টি থামলেও সারা দিন আকাশ মেঘলা ছিল । মাঝে মাঝে রোদ দেখা গেছে। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি। জামী ছড়া কাটছিল, ‘রোদ হয় বৃষ্টি হয়, খ্যাঁক-শিয়ালির বিয়ে হয়।' কিন্তু আমার মনে পাষাণভার। এখন সন্ধ্যার পর বৃষ্টি নেই, ঘনঘন মেঘ ডাকছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমার জীবনেও এতদিনে সত্যি সত্যি দুর্যোগের মেঘ ঘন হয়ে আসছে। এই রকম সময়ে করিম এসে ঢুকল ঘরে, সামনে সোফায় বসে বলল, ‘ফুফুজান এ পাড়ার অনেকেই চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। আপনারা কোথাও যাবেন না?'
‘কোথায় যাব? অন্ধ, বুড়ো শ্বশুরকে নিয়ে কেমন করে যাব? কিন্তু এ পাড়া ছেড়ে লোকে যাচ্ছে কেন? এখানে তো কোনো ভয় নেই!”
‘নেই, মানে? পেছনে এত কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো—'
‘হল তো সব খালি, বিরান, যা হবার তা তো প্রথম দুদিনেই হয়ে গেছে । জানো,বাবুদের বাড়িতে তার মামার বাড়ির সবাই এসে উঠেছে শান্তিনগর থেকে?
“তাই নাকি? আমরা তো ভাবছিলাম শান্তিনগরে আমার দুলাভাইয়ের বাসায় যাব।' ‘তাহলেই দেখ— ভয়টা আসলে মনে। শান্তিনগরের মানুষ এলিফ্যান্ট রোডে আসছে মিলিটারির হাত থেকে পালাতে, আবার তুমি এলিফ্যান্ট রোড থেকে শান্তিনগরেই যেতে চাচ্ছ নিরাপত্তার কারণে ।যুক্তিটা বুঝে করিম মাথা নাড়ল, ‘খুব দামি কথা বলেছেন ফুফুজান। আসলে যা কপালে আছে তা হবেই। নইলে দ্যাখেন না, ঢাকার মানুষ খামোকা জিঞ্জিরায় গেল গুলি খেয়ে মরতে। আরো একটা কথা শুনেছেন ফুফুজান? নদীতে নাকি প্রচুর লাশ ভেসে যাচ্ছে। পেছনে হাত বাঁধা, গুলিতে মরা লাশ।'
শিউরে উঠে বললাম, ‘রোজই শুনছি করিম। যেখানেই যাই এছাড়া আর কথা নেই । কয়েকদিন আগে শুনলাম ট্রাকভর্তি করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হাত আর চোখ বেঁধে, কতো লোকে দেখেছে। এখন শুনছি সদরঘাট, সোয়ারীঘাটে নাকি দাঁড়ানো যায় না পচা লাশের দুর্গন্ধে। মাছ খাওয়াই বাদ দিয়েছি এজন্যে ।’

১০ই মে : সোমবার ১৯৭১
বেশ কিছুদিন বাগানের দিকে নজর দেওয়া হয় নি। আজ সকালে নাশতা খাবার পর তাই বাগানে গেলাম। বাগানে বেশ কটা হাই-ব্রিড টি-রোজের গাছ আছে। এই ধরনের গোলাপ গাছের খুব বেশি যত্ন করতে হয়— যা গত দুমাসে হয়নি। খুরপি হাতে কাজে লাগার আগে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম । মাখনের মতো রঙের ‘পিস্' অর্থাৎ ‘শান্তি’। কালচে-মেরুর ‘বনি প্রিন্স' আর ‘এনা হার্কনেস । ফিকে ও গাঢ় বেগুনি রঙের ‘সিমোন’ আর ‘ল্যাভেন্ডার।’ হলুদ ‘বুকানিয়ার’, সাদা ‘পাস্কালি' ।
বনি প্রিন্স-এর আধফোটা কলিটি এখনো আমার বেড-সাইড টেবিলে কালিদানিতে রয়েছে। কলি অবশ্য আর নেই, ফুটে গেছে এবং প্রায় ঝরে পড়ার অবস্থা। ‘পিস'-এর গাছটায় একটা কলি কেবল এসেছে— যদিও সারাদেশ থেকে ‘পিস' উধাও ।
বাগান করা একটা নেশা। এ নেশায় দুঃখ-কষ্ট খানিকক্ষণ ভুলে থাকা যায়। গত কয়েক মাস ধরে নেশাটার কথা ভাববারই অবকাশ পাই নি। এখন ভয়ানক বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার গরজেই বোধ করি নেশাটার কথা আমার মনে পড়েছে।
১২ই মে : বুধবার ১৯৭১
জামীর স্কুল খুলেছে দিন দুই হলো। সরকার এখন স্কুল-কলেজ জোর করে খোলার ব্যবস্থা করছে। এক তারিখে প্রাইমারি স্কুল খোলার হুকুম হয়েছে, নয় তারিখে মাধ্যমিক স্কুল।
জামী স্কুলে যাচ্ছে না । যাবে না। শরীফ, আমি, রুমী, জামী- চারজনে বসে আলাপ-আলোচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্কুল খুললেও স্কুলে যাওয়া হবে না। দেশে কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা। দেশবাসীর ওপর হানাদার পাকিস্তানি জানোয়ারদের চলছে নির্মম নিষ্পেষণের স্টিমরোলার। এই অবস্থায় কোনো ছাত্রের উচিত নয় বই-খাতা বগলে স্কুলে যাওয়া।
জামী অবশ্য বাড়িতে পড়াশোনা করছে। এবার ও দশম শ্রেণির ছাত্র। রুমী যতদিন আছে, ওকে
সাহায্য করবে। তারপর শরীফ আর আমি- যে যতটা পারি ।
জামী তার দু-তিনজন বন্ধুর সাথে ঠিক করেছে—ওরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে পড়াশোনা করবে। এটা বেশ ভালো ব্যবস্থা, পড়াও হবে, সময়টাও ভালো কাটবে। অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় ওরা হাঁপিয়ে উঠবে না ।

১৭ই মে : সোমবার ১৯৭১
রেডিও-টিভিতে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে প্রোগ্রাম করিয়েও ‘কর্তাদের’ তেমন সুবিধা হচ্ছে না বোধ হয়! তাই এখন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের ধরে ধরে তাদের দিয়ে খবরের কাগজে বিবৃতি দেওয়ানোর কূটকৌশল শুরু হয়েছে। আজকের কাগজে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নাম দিয়ে এক বিবৃতি বেরিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো টিচার, রেডিও-টিভির কোনো কর্মকর্তা ও শিল্পীর নাম বাদ গেছে বলে মনে হচ্ছে না। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সানন্দে এবং সাগ্রহে সই দিলেও বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী যে বেয়নেটের মুখে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আর যে বিবৃতি তাদের নামে বেরিয়েছে, সেটা যে তাঁরা অনেকে না দেখেই সই করতে বাধ্য হয়েছেন, তাতেও আমার সন্দেহ নেই। আজ সকালের কাগজে বিবৃতিটি প্রথমবারের মতো পড়ে তাঁরা নিশ্চয় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইবেন খানিকক্ষণ! এবং বলবেন, ধরণী দ্বিধা হও! এরকম নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণে ভরা বিবৃতি স্বয়ং গোয়েবলসও লিখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। এই পূর্ব বাংলার কোন প্রতিভাধর বিবৃতিটি তৈরি করেছেন, জানতে বড়ো ইচ্ছে হচ্ছে।

২৫ শে মে : মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। বেশ শান-শওকতের সঙ্গে পালিত হচ্ছে ঢাকায়। এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশন পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠান করছে। সন্ধ্যার পর টিভির সামনে বসেছিলাম, জামী সিঁড়ির মাথা থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকল, ‘মা শিগগির এস। নতুন প্রোগ্রাম ।’
দৌড়ে ওপরে গেলাম, স্বাধীন বাংলা বেতারে বাংলা সংবাদ পাঠ করছে নতুন এক কণ্ঠস্বর। খানিক শোনার পর চেনা চেনা ঠেকল কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না। সালেহ আহমদ নামটা আগে কখনো শুনি নি। রুমী বলল, “নিশ্চয় ছদ্মনাম।' বললাম, ‘হতে পারে। তবে ঢাকারই লোক এ । এই ঢাকাতেই এই গলা শুনেছি। হয় নাটক, নয় আবৃত্তি।’
এইসব গবেষণা করতে করতে বাংলা সংবাদপাঠ শেষ ।
আজকের প্রোগ্রামেও বেশ নতুনত্ব। কণ্ঠস্বরও সবই নতুন শুনছি। একজন একটা কথিকা পড়লেন - চরমপত্র। বেশ মজা লাগল শুনতে, শুদ্ধ ভাষায় বলতে বলতে হঠাৎ শেষের দিকে এক্কেবারে খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষাতে দুটো লাইন বলে শেষ করলেন।
অদ্ভুত তো। কিন্তু এখানে আলটিমেটামের মতো কিছু তো বোঝা গেল না ।
শরীফ বলল, ‘ঐ যে বলল না একবার যখন এ দেশের কাদায় পা ডুবিয়েছ, আর রক্ষে নেই । গাজুরিয়া মাইরের চোটে মরে কাদার মধ্যে শুয়ে থাকতে হবে, এটা আলটিমেটাম।' ‘কি জানি ৷’
জামী জানতে চাইল, ‘গাজুরিয়া মাইর কি জিনিস?”
রুমী বলল, ‘জানি না । আমার ঢাকাইয়া বন্ধু কাউকে জিগ্যেস করে নেব।'ঐ যে মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতার কথা বলল- ঢাকার ছ’জায়গায় গ্রেনেড ফেটেছে, আমরা তো সাত আটদিন আগে এ রকম বোমা ফাটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করি নি। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি? আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি! সত্যি সত্যি তাহলে ঢাকার আনাচে-কানাচে মুক্তিফৌজের গেরিলারা প্রতিঘাতের ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে শুরু করেছে?
এতদিন জানছিলাম বর্ডারঘেঁষা অঞ্চলগুলোতেই গেরিলা তৎপরতা। এখন তাহলে খোদ ঢাকাতেও? মুক্তিফৌজ! কথাটা এত ভারী যে এই রকম অত্যাচারী সৈন্য দিয়ে ঘেরা অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে মুক্তিফৌজ শব্দটা শুনলেও কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার ঐ অবিশ্বাসের ভেতর থেকে একটা আশা, একটা ভরসার ভাব ধীরে ধীরে মনের কোণে জেগে উঠতে থাকে ।

৫ই সেপ্টেম্বর : রবিবার ১৯৭১
একটা কঠিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে গত দুদিন থেকে শরীফ আর আমি খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি । রুমীকে কি করে বের করে আনা যায়, তা নিয়ে শরীফের বন্ধুবান্ধব নানারকম চিন্তাভাবনা করছে। এর মধ্যে বাঁকা আর ফকিরের মত হলো : যে কোনো প্রকারে রুমীকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। বাঁকা আর ফকির মনে করছে— শরীফকে দিয়ে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে একটা মার্সি পিটিশন করিয়ে তদবির করলে রুমী হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতেও পারে।
রুমীর শোকে আমি প্রথম চোটে ‘তাই করা হোক' বলেছিলাম। কিন্তু শরীফ রাজি হতে পারছে না। যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমী সেটা মোটেও পছন্দ করবে না এবং রুমী তাহলে আমাদের কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। বাঁকা ও ফকির অনেকভাবে শরীফকে বুঝিয়েছে— ছেলের প্রাণটা আগে। রুমীর মতো এমন অসাধারণ মেধাবী ছেলের প্রাণ বাঁচলে দেশেরও মঙ্গল। কিন্তু শরীফ তবু মত দিতে পারছে না । খুনি সরকারের কাছে রুমীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে দয়াভিক্ষা করা মানেই রুমীর আদর্শকে অপমান করা, রুমীর উঁচু মাথা হেঁট করা। গত দুরাত শরীফ ঘুমোয় নি, আমি একবার বলেছি, ‘তোমার কথাই ঠিক। ঐ খুনী সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করা যায় না।' আবার খানিক পরে কেঁদে আকুল হয়ে বলেছি, ‘না, মার্সি পিটিশন করে ৷
এইভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেটেছে দুদিন দুরাত । শেষ পর্যন্ত শরীফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- না, মার্সি পিটিশন সে করবে না। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমিও শরীফের মতকে সমর্থন করেছি। রুমীকে অন্যভাবে বের করে আনার যতরকম চেষ্টা আছে, সব করা হবে; কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয় ।

১১ই অক্টোবর : সোমবার ১৯৭১
শরীফ বলল, ‘সেই যে মাস খানেক আগে কাগজে পড়েছিলাম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের
কথা, তার সম্বন্ধে আজ শুনে এলাম ।' “কী শুনে এলে? কোথায় শুনলে ?
‘ডা. রাব্বির কাছে। রাব্বি- জানো তো, আমাদের সুজার ভাস্তে ।'
শরীফের এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু সুজা সাহেব, তাঁর ভাস্তে ডা. ফজলে রাব্বি ।শরীফ বলল, ‘আজ ফকিরের অফিসে গেছিলাম, ওখানে রাব্বির সঙ্গে দেখা। ওর মুখেই শুনলাম মতিয়ুর রহমানের ফ্যামিলি ২৯ সেপ্টেম্বর করাচি থেকে ঢাকা এসেছে। মতিয়ুর রহমানের শ্বশুর গুলশানের এক বাড়িতে থাকেন। সেইখানে ৩০ তারিখে মতিয়ুরের চল্লিশা হয়েছে। রাব্বি গিয়েছিল চল্লিশায়। মিসেস মতিয়ুর নাকি বাংলা বিভাগের মনিরুজ্জামানের শালী ।'
‘আমাদের স্যার মনিরুজ্জামানের? তার মানে ডলির বোন? দাঁড়াও, দাঁড়াও— এই বোনকে তো দেখেছি ডলিদের বাসায়- মিলি এর নাম। '
ডলির কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ডলি, মনিরুজ্জামান স্যার, ওদের কোনো খোঁজই জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে কোথায় যে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে- কে জানে। ওপারেও যায় নি, গেলে বেতারে নিশ্চয় গলা শুনতে পেতাম। স্বাধীন বাংলা বেতারে বহু পরিচিতজনের গলা শুনি, তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে, কিন্তু গলা শুনে চিনতে পারি। প্রথম যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে সালেহ আহমদের কণ্ঠে খবর শুনি, খুব চেনা চেনা লেগেছিল, দু একদিন পরেই চিনেছিলাম- সে কণ্ঠ হাসান ইমামের ইংরেজি খবর ও ভাষ্য প্রচার করে যারা, সেই আবু মোহাম্মদ আলী ও আহমেদ চৌধুরী হলো আলী যাকের আর আলমগীর কবির। গায়কদের গলা তো সহজেই চেনা যায়- রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল জব্বার, অজিত রায়, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, হরলাল রায়। কথিকায় সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসান, ফয়েজ আহমদ প্রায় সকলেরই গলা শুনে বুঝতে পারি। নাটকে রাজু আহমেদ, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়— এদের সবার গলাই এক লহমায় বুঝে যাই ।

১৬ই ডিসেম্বর : বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ সকাল নটা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ-বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেলে তিনটে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাকিস্তানি আর্মি নাকি সারেন্ডার করবে বিকেলে । সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এলো সবার মুখেই এক কথা। দলে দলে লোক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে। পাকিস্তানি সেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে। পালাতে পালাতে পথেঘাটে এলোপাথাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন । বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময় বেপরোয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লোক জখম করেছে।
মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।'
আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে আসতে। এ.কে.খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে।
জেনারেল নিয়াজী তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল ৪টা ৩১
মিনিটে। যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব? আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য । মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন ।রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মসলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম ।

Content added By

জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩রা মে মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল আলী। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। জাহানারা ইমাম ১৯৪৭ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড ও বাংলায় এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রথম সন্তান রুমী যোগদান করেন। রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে জাহানারা ইমাম সহযোগিতা করেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্যের জোগান, গাড়িতে অস্ত্র আনা-নেওয়া এবং তা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেওয়া, খবর আদান-প্রদান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে তিনি সর্বান্তকরণে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষদিকে রুমী শহিদ হন। জাহানারা ইমাম হন আমাদের শহিদ জননী। মুক্তিযুদ্ধের ওপর স্মৃতিচারণমূলক তাঁর অসাধারণ গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি সর্বত্র সমাদৃত। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো : গজকচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনগুলি ইত্যাদি। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। একাত্তরের ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের শাস্তির দাবিতে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। ১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন এই মহীয়সী নারী পরলোকগমন করেন ।

Content added By

জামী - লেখিকার ছোট ছেলে। বিরান— জনমানবহীন, পরিত্যক্ত, ফাঁকা। খুরপি- মাটি খোঁড়ার জন্য ব্যবহৃত একপ্রকার ছোট খন্তা। শরীফ- লেখিকার স্বামী - জামীর ভাই। অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তা- রুদ্ধ বা আটক অবস্থায় কর্মহীনতা। কূটকৌশল- চতুরতা, দুর্বুদ্ধি। বেয়নেট— বন্দুকের সঙ্গিন, বন্দুকের অগ্রভাগে লাগানো একপ্রকার বিষাক্ত ও ধারাল ছোরা। স্তম্ভিত- হতবাক, বিস্মিত গোয়েবলস্ (১৮৯৭-১৯৪৫) - জার্মান বংশোদ্ভূত হিটলারের সহযোগী, রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও মিথ্যা রটনার প্রবর্তক। কথিকা- নির্দিষ্ট ও ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনাত্মক রচনা। চরমপত্র- মৃত্যুর পূর্বসময়ে লিখিত উপদেশ, শেষবারের মতো সতর্ক করে দেওয়ার জন্য প্রেরিত পত্র, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ‘স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র' থেকে এম. আর. আকতার মুকুল কর্তৃক লিখিত হানাদার বাহিনীর অপকীর্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য নিয়ে হাস্যরসাত্মক এই কথিকাগুলো প্রচারিত হতো। এই কথিকাগুলো ‘চরমপত্র' নামে খ্যাত। আলটিমেটাম- চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ। গাজুরিয়া মাইর- গজারি কাঠের মতো শক্ত ও ভারী কাঠের লাঠি দিয়ে মার দেওয়া। মার্সি পিটিশন— শাস্তি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন; লহমায়— মুহূর্তে।

Content added By

জাহানারা ইমাম রচিত একাত্তরের দিনগুলি শীর্ষক দিনপঞ্জির আকারে রচিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ থেকে পাঠ্যভুক্ত অংশটুকু গৃহীত হয়েছে। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সন্তান রুমীকে হারিয়েছেন। এই রচনায় গভীর বেদনার সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে তিনি তাঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা ব্যক্ত করেছেন । পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় প্রথমেই ঢাকার নগর-জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। শিশু-কিশোররা স্কুলে যাবে না। কিন্তু হানাদার বাহিনী জোর করে স্কুল-কলেজ খোলা রাখবে; বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে জোর করে রেডিও-টিভিতে বিবৃতি প্রদান করাবে; আর হত্যা-লুণ্ঠন-অগ্নি সংযোগ তো আছেই— এই ছিল সেই দুঃসময়ে ঢাকার অবস্থা। ‘একাত্তরের দিনগুলি' মুক্তিযুদ্ধে মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক অংশগ্রহণের ইতিহাস তুলে ধরে। সন্তানের প্রতি গভীর মমতা ও সংবেদনশীল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও জাতির প্রয়োজনে সন্তানকে উৎসর্গ করেছেন জাহানারা ইমাম। স্মৃতিচারণমূলক এ লেখা মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় ও সরব অংশগ্রহণের বিবরণ উপস্থাপন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করে তোলে ।

Content added By